lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫
Last Updated 2025-11-03T04:11:51Z
জাতীয়

আটোয়ারীতে এফিডেভিট বিয়েতে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়

Advertisement


 

সালাম মুর্শেদী, (পঞ্চগড়) প্রতিনিধিঃ কোর্ট ম্যারেজ বা এফিডেভিট বিয়ে কি সত্যিই বৈধ বিয়ে হয়? এক কথায় উত্তরে বলা যায়, 'না'। পৃথিবীর কোনো ধর্মেই কোর্ট ম্যারেজ বা এফিডেভিট বিয়ে আইনগত ভাবে কোন ভিত্তি নেই। এটি লোকমুখে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ মাত্র। মূলত বিয়ের কাবিননামাই হলো বিয়ের মূল চুক্তিপত্র। বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সম্মতিতে এবং সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি মেনে একটি বৈধ সম্পন্ন হয়। এরপর বিবাহ রেজিস্টার বা কাজী আইন অনুযায়ী এই বিয়ের নিবন্ধন করলেই আইনগতভাবে আর কোন ত্রুটি থাকে না। আর কোর্ট ম্যারেজ হলো এফিডেভিট বা বিয়ের ঘোষণা মাত্র। কিন্তু এভিডেভিট আদৌ কোনো বিয়ে নয়। 

এছাড়াও অনেক দেশে (যেমন বাংলাদেশে) আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো বা নিবন্ধন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একটি হলফনামা যেখানে কোনো ব্যক্তি শপথ করে কোনো সত্য ঘটনা নিশ্চিত করেন, যেমন বিবাহের অঙ্গীকার। যদিও এফিডেভিট অনেক ক্ষেত্রে বিবাহের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটি নিজেই একটি আইনি বিবাহ নয় এবং এর মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো বা নিবন্ধন করা নিষিদ্ধ। এটি সাধারণত নাম, বয়স বা ঠিকানার মতো তথ্য সংশোধনের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং বিবাহ সংক্রান্ত হলফনামা শুধু একটি ঘোষণা মাত্র, কিন্তু আইনগতভাবে এফিডেভিট একটি বৈধ বিবাহ প্রমাণ করে না। 


কিন্তু বর্তমান সময়ে সমাজে দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিকের গন্ডি পাড় না হতেই অনেক ঊর্তি বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও বয়ঃসন্ধিকালের ধারা পাড় না হতেই করে ফেলছে নানা ধরনের অপরাধ। এমনকি নানা অসামাজিক কার্যকলাপে তারা জড়িয়ে পড়ছে। শেষমেশ প্রেমের সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে অনেক ছেলেমেয়ে কোর্টের দারস্থ হচ্ছে। কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাহায্য নিয়ে অবিভাবকদের অজান্তেই কোর্ট ম্যারেজ বা এফিডেভিট করে নিচ্ছে। সেখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- অনেক সময় দেখা গেছে, মাধ্যমিকের গন্ডি পাড় না হওয়া সেই ছেলেমেয়েদের জন্ম নিবন্ধনের সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই না করে সংশ্লিষ্ট শনাক্তকারী আইনজীবী তাদের এফিডেভিট করে দিচ্ছেন। অথচ এফিডেভিট যদিও বিয়ে নয় তারপরও সেটা করার সময় উভয়ের জন্ম নিবন্ধনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর অত্যাবশ্যকীয় কাজ। কিন্তু অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছেনা। ফলে দিনশেষে দেখা যায়, ওই মেয়েটি ছেলের বাসায় স্ত্রীর স্বীকৃতি পেতে সে-ই এফিডেভিটের কাগজ নিয়ে ছেলের বাসায় অনশন করে। যার কারণে সমাজের মধ্যে বাড়ছে জটিলতা, বিশৃঙ্খলা ও চরম অবক্ষয়। এছাড়াও সমাজের প্রভাবশালী কিছু দলীয় লোকজন তৃতীয় পক্ষ হয়ে ওই বিষয়গুলো অর্থের বিনিময়ে সমাধানের চেষ্টা করে অথবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আর এই অর্থের বিনিময়ের জন্য বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছেলেমেয়ের উভয়ের পরিবার।


সম্প্রতি পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে ১৫ বছর বসয়ী এক ছেলের বাসায় ২১ বছর বয়সী এক মেয়ের অনশনের ঘটনায় পুরো এলাকায় উদ্বেগ ও চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। জানা যায়, উপজেলার আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের ঝাকোয়াপড়া গ্রামের সুবাস বর্মণের ছেলে নয়ন বর্মণ (১৫) এর বাসায় পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলার লাহিড়ী ইউনিয়নের ২১ বছর বয়সী এক মেয়ে স্ত্রীর স্বীকৃতি চেয়ে অনশন করে। সাথে নিয়ে এসেছেন গত (২৪ সেপ্টেম্বর) ঠাকুরগাঁও জজ কোর্টে করা এক এফিডেভিটের কাগজ আর হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে একটা ফি আদায়ের রশিদ। যদিও তাদের বিয়েটা কোনো বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে রেজিস্ট্রি করা হয়নি। এদিকে সে-ই মেয়ের আসার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে লাপাত্তা হয়েছে নয়ন বর্মণ।


ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই মেয়ের সাথে কথা বললে জানা যায়, গত চার মাস পূর্বে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে৷ সেই থেকে ফেসবুক মেসেঞ্জার আর ইমুতে নিয়মিত কথা বলা সহ বিভিন্ন সময় ঘুরতে যাওয়া হতো তাদের। সেই সম্পর্কের জের ধরে গত (২৪ সেপ্টেম্বর) ঠাকুরগাঁও জজ কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করে দুজনেই। সেখানে নয়ন বর্মণের বয়স দেওয়া হয় ২১ বছর এবং মেয়ের বয়স দেওয়া হয় ১৯ বছর। প্রকৃতঅর্থে, জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী নয়নের জন্ম ২০১০ সালে এবং মেয়ের জন্ম ২০০৫ সালে। এছাড়াও তার কাছে থাকা হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে ফি আদায়ের রশিদে দেখা যায়, শুধু মাত্র মেয়ের নাম-ঠিকানা লিখা একটি কাগজ। সেখানে কোনো ছেলের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ্য করা নাই। যদিও ফি আদায়ের রশিদে বর ও কনে পক্ষের উভয়ের নাম উল্লেখ্য থাকার কথা ছিল।


এ বিষয়ে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সেই হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার সুধীর চন্দ্র সিংহের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোর্টের এফিডেভিটের কাগজ অনুযায়ী গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত বয়স হয়েছে কিনা এবং তাদের জন্ম নিবন্ধনের কাগজ দেখে তিনি বিয়ে দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, আসলে মেয়েটা আমাদের এলাকার তো তাই কাজটা তারাতাড়ি হয়ে গেছে। মেয়ের বাবা এসে শুধু ফি আদায়ের রশিদটা নিয়ে গেছে। আর ছেলেমেয়ের সঠিক বয়স কত সেটা আমার জানা নাই। কারণ আমি কোর্টের এফিডেভিটের কাগজ দেখে আমার রেজিস্ট্রার খাতায় তাদের নাম ঠিকানা লিখেছি।


এফিডেভিটের বিষয় শনাক্তকারী আইনজীবী অনিমেস চন্দ্র মুনি জানান, এফিডেভিট কোনো বিয়ে নয়৷ সেটা কেবলমাত্র ঘোষণা পত্র। তারা আমাদের কাছে এসে নিজ নিজ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমরা তা লিখেছি। তাদের জন্ম নিবন্ধনের কাগজ ছাড়া কিভাবে এফিডেভিট করে দেওয়া যায় এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তারা আমাদের কাছে এসে শুধু নিজেদের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমরা তাই ঘোষণা পত্রে উল্লেখ্য করেছি। নিজেদের ঘোষণা তারা নিজেরাই দিয়েছে সেক্ষেত্রে কোনো কাগজপত্র দরকার হয়নি। 

এ নিয়ে নয়ন বর্মণের বাবা সুবাস বর্মণ জানান, আমার ছেলের সাথে ওই মেয়ের যোগাযোগ ছিল সত্যি। তাদের মধ্যে কথাবার্তাও হতো। কিন্তু আমার ছেলের বয়স মাত্র ১৫ বছর। আর ওই মেয়ের বয়স ২১ বছর। তারা যদি কোর্টে এফিডেভিট করেও থাকে তাহলে সেখানে কেন আমার ছেলের বয়স ২১ দেখানো হল। আর মেয়ের বয়স মাত্র ১৯ দেখানো হল। কেন ছেলের জন্ম নিবন্ধনের কাগজ ছাড়াই উকিলরা সেটা করল। তারমানে মেয়ের পক্ষ সব কিছু পরিকল্পিত ভাবে করেছে৷ তা না হলে কেন ছেলের বিস্তারিত না জেনে বয়স বাড়িয়ে এফিডেভিট করা হলো এবং মেয়ের বয়স কমানো হলো। কিন্তু এফিডেভিট তো কোনো বিয়ে নয়। এছাড়াও কোনো হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছেও তাদের বিয়ে হয়নি। জোর করে আমার ছেলেকে দিয়ে শাখা-সিঁদুর পড়ানো হয়েছে।


এফিডেভিটের বিষয়ে পঞ্চগড় কোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এড. মাসুদ পারভেজ বলেন, এফিডেভিট কোনো বিয়ে নয়। এটা কেবলমাত্র একটি ঘোষণাপত্র৷ তারপরও এফিডেভিটের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর কাছে উপযুক্ত তথ্য ও প্রমাণাদি অত্যাবশ্যকীয়। যদি ছেলেমেয়ের এফিডেভিট করা হয় তাহলে অবশ্যই তাদের জন্ম নিবন্ধনের কাগজ সহ সব কিছু সঠিকভাবে যাচাই করে এভিডেভিট দিতে হবে।