Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
মো. শফিকুল ইসলাম। বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের সাতপাড়িয়া গ্রামে। নিন্মবিত্ত পরিবারের সন্তান শফিকুলের লেখাপড়া দরিদ্রতার কারনে বেশিদুর এগোয়নি। ২০১৫ সালে দিনমজুর বাবা জমির মিয়া মারা যাবার পর শফিকুলদের পরিবারে নেমে আসে অমানিষার অন্ধকার। ওই সময়ে বিশ বছর বয়সী তরুণ শফিকুল ধরেন পরিবারের হাল। মা, ছোট দুই বোন ও এক ভাইকে নিয়ে পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান শফিকুল কখনো ঠেলাগাড়ি চালিয়ে, কখনো রাজমিস্ত্রী সহকারী হিসেবে কাজ করে পরিবারের বোঝা টানতে থাকেন। যেদিন কাজ থাকে না সেদিন তার পরিবারের পেটে ভাতও জোটেনি। ২০২০ সালে শফিকুল তার প্রতিবেশি এক বন্ধুর মাধ্যমে পর্যটন নগর হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গলের বধ্যভূমি একাত্তর এলাকা থেকে রাধানগর এলাকা পর্যন্ত ভ্যান গাড়িতে আনারস বিক্রির কাজ শুরু করেন। এসব এলাকা প্রায় প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি হাজার-হাজার পর্যটকে মুখরিত থাকে। বিশেষ করে সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার যেন পর্যটকের ঢল নামে। শ্রীমঙ্গলে আগত পর্যটকদের কাছে আনারস কেটে বিট লবন, কাঁচামরিচ মাখিয়ে বিক্রি করে এখন শফিকুল স্বাবলম্বি। পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে গড়ে প্রতিদিন তিনি বিক্রি করছেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার রসালো আনারস। এতে লাভ হয় দুই হাজার টাকার মতো। ভ্যান গাড়িতে আনারস বিক্রির লভ্যাংশ দিয়ে নিজে বিয়ে করা ছাড়াও দুই বোনকে পাত্রস্থ করেছেন তিনি। এখন তার পরিবারে বইছে শান্তি ও সুখের সুবাতাস। শফিকুল জানান, এখন আর তার পরিবারে অভাবের ছিটেফোটা নেই। ভ্যান গাড়িতে আনারস বিক্রি করে ছোট দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে নিজেও থিতু হয়েছেন সংসারে। ছোট ভাইকে শেখাচ্ছেন লেখাপড়া। শুধু শফিকুল নয়, দেশের পর্যটন নগর হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গলে পর্যটন এলাকায় ভ্যানে করে আনারস বিক্রি করে স্বাবলম্বি হয়েছেন শহরের গুহ রোডের বাসিন্দা হেলাল মিয়া, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নোমান হোসেন, জামাল হোসেন রনি, শহরতলীর শাহীবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, জুবায়ের পলাশ, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের মোহাজেরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন, ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের বাসিন্দা মো. জালাল মিয়া, আব্দুস সালাম, জয়নাল আবেদিন, লালবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আলাল মিয়া, সবুজবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সুবল দেবনাথ, ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের দোগাংগা গ্রামের বাসিন্দা মো. নুর মিয়া প্রমুখরা।
আলাপকালে আনারস বিক্রেতা সুজন মিয়া বলেন, ‘এক সময় বেকার জীবন যাপন করতাম। শ্রীমঙ্গলে প্রচুর পরিমাণ পর্যটক আগমনের কারনে ভ্যানে করে বাগানের তাজা আনারস বিক্রি শুরু করি। সপ্তাহের রবি থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে ভ্যানে আনারস সাজিয়ে বসি। শুক্র ও শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়। এ ব্যবসা করে ভালো আছি। আমরা প্রায় ২৫ জনের মতো রিকশা ভ্যানে করে আনরাস কেটে বিক্রি করছি। প্রতিটি আনারস বড় সাইজ ভেদে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫-৬ হাজার টাকার আনারস বিক্রি হয়। এখন অনেক ভালো আছি।’
আনারস বিক্রেতা মো. জালাল মিয়া বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল বর্তমানে পর্যটকদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট স্থান। বহু মানুষ প্রতিদিন এখানে ভ্রমণে আসেন। এখানে প্রচুর পরিমাণে আনারস উৎপন্ন হয়। এসব আনারসের অধিকাংশই এক সময় শ্রীমঙ্গলের বাইরে বিক্রি হতো। এখন আর বাইরে বিক্রির জন্য পাঠাতে হয় না। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আমাদের মূল ক্রেতা। প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার আনারস বিক্রি করতে পারছি। লাভও হয় ভালো। পরিবার চালাতে এখন আর চিন্তা করতে হয় না।’
সুবল দেবনাথ বলেন, ‘আমরা ভ্যানে করে আনারস বিক্রেতারা বধ্যভূমি একাত্তর চত্ত¡র থেকে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের সামনে পর্যন্ত চা বাগানের পাশে ভ্যান গাড়িতে করে আনারস কেটে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছি। স্থানীয় বাগানগুলোতে প্রচুর আনারস ফলে। এসব আনারস বাগান মালিকদের কাছ থেকে পাইকারী দরে কিনে এনে আমরা কেটে পিছ পিছ করে বিট লবনসহ নানা মশলা দিয়ে পরিবেশন করি। এ ব্যবসা আমাদের স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত। আমরা ব্যবসাটি করে ভালোভাবে চলতে পারছি। এ ব্যবসায় পুঁজি হলো ভ্যান গাড়ি ও আনারস কেনা। প্রতিদিন গড়ে ৭-৮ হাজার বিক্রি হয়।’
আলাল মিয়া বলেন, ‘আমরা শ্রীমঙ্গলে সুনাম যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে নজর রাখি। শ্রীমঙ্গলে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সাথে মধু ব্যবহার করি। আনারস আমরা ন্যায্যমূল্যে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করি। প্রতি পিছ আনারস কেটে বিক্রি করছি ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। আমরা যারা ভ্যানে করে আনারস বিক্রি করছি তাদের ব্যবহারে পর্যটকরা মুগ্ধ হন।’
রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থেকে সপরিবারে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে আসা মিসেস সাফিয়া বেগম বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে এসে এভাবে রিকশা ভ্যানে আনারস কেটে বিক্রির বিষয়টি দেখলাম। খুব স্বল্পমূল্যে তাজা আনারস খেতে পেরে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা খুব খুশি। সাধারণত পর্যটন এলাকায় জিনিসপত্রের দাম থাকে একটু চড়া। কিন্তু আনারস খেতে গিয়ে দেখলাম দাম তুলনামূলক অনেক কম। আনারস বিক্রেতাদের ব্যবহারও চমৎকার। এছাড়া আনারস কাটার পর পরিস্কার পানিতে ধুয়ে মশলা দিয়ে আমাদের পরিবেশন করেছে। বিষয়টি খুব পুলকিত করেছে আমাদের।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়া এলাকার মশিউর রহমান বললেন, ‘শ্রীমঙ্গলে এসে কম দামে খুবই মজাদার আনারস খেলাম। যে আনারস আমরা ৩০ টাকায় খেয়েছি এটি আমাদের শহরে হলে দাম হতো কমপক্ষে ৫০ টাকা। বোনাস হিসেবে পেলাম আনারস কেটে লবন, মরিচ দিয়ে আপ্যায়ণ। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো এবারের ভ্রমণে। আনারস ব্যবসায়ীদের আচার-আচরণও ভালো লেগেছে। আমরা যেখান থেকে আনারস কিনে খেয়েছি সে দোকানের মালিক আমাদের প্রথমেই আমাদের বললেন আপনারা মেহমান, আমাদের লহ্মী। অসাধারণ তার বাচনভঙ্গী। খুব প্রীত হলাম এবারের ভ্রমণে। এবার সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি মধুর কিছু অভিজ্ঞতা।’
সুনামগঞ্জের শাহিনুর রহমান বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসার কাজে আমাকে যেতে হয়। কত রকম ব্যবসা দেখেছি এ জীবনে। তবে শ্রীমঙ্গলের পর্যটন স্পটগুলোর আশেপাশে রিকশা ভ্যানে করে স্থানীয় রসালো পণ্য আনারসের এ ধরণের ব্রন্ডিং খুবই ভালো লেগেছে।’