Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
বাংলাদেশী বংশদ্ভূত কানাডা প্রবাসী ফুটবলার সমিত সোম। কানাডার জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সমিত খেলছেন কানাডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল কালাভরি এফসিতে। তিনি একজন মিডফিল্ডার। সমিত সোমের বাবা মানস সোম এবং মা নন্দিনা সোম দুই জনেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। সমিত ফুটবলার ছাড়াও একজন প্রকৌশলী। আর তার একমাত্র বোন ইস্পিতা সোম চিকিৎসক। সমিতের পৈত্রিক নিবাস মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের ছায়াঘেরা নিভৃত গ্রাম দক্ষিণ উত্তরসুরে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আগামী ১০ জুন সিঙ্গাপুর জাতীয় দলের বিপক্ষে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) কাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচে বাংলাদেশ জাতীয় দলে সমিতের অভিষেক হতে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে ৩ জুন তিনি দেশে আসবেন। দেশের মাটিতে পা রেখে রাত্রীযাপন করবেন শ্রীমঙ্গলস্থ নিজ গ্রামের বাড়িতে। তারপর জাতীয় দলের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে চলে যাবেন ঢাকা। জীবনে অসংখ্যবার সমিত সোম তার পৈত্রিক বাড়িতে এলেও এবারে দেশের ফুটবলের জন্য এক অনন্য এক সম্ভবনা নিয়ে আসছেন। গত ৬ মে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের হয়ে খেলতে অনুমতি দিয়েছে ২৭ বছর বয়সী এই ফুটবলারকে। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলে যুক্ত হলো এক নতুন সম্ভাবনার নাম।
এদিকে বাংলাদেশী বংশদ্ভূত কানাডা প্রবাসী ফুটবলার সমিত সোমকে নতুন রূপে বরণে সাজ সাজ রব পড়েছে তার পৈত্রিকভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা, দক্ষিণ উত্তরসুর গ্রাম ও সমিতের পৈত্রিক নিবাস সোম বাড়িতে। পুরো শ্রীমঙ্গলবাসীর সাথে এলাকার তরুণ-যুবকরাও তাকে বরণে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আনন্দের বন্যা বইছে সমিতের পরিবারে।
সরজমিনে সমিত সোমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে ধোয়া-মুছার কাজ চলছে। রঙ করা হয়েছে বাউন্ডারি দেয়ালসহ পুরো বাড়ি। সমিত সোমের কাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহন লাল সোম সবকিছু তদারকি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজা সমিত সোম এবার একাই আসছে বাংলাদেশে। সে দেশে আসার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আমি প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছি, আর আমার ভাতিজা ফুটবলে জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে এটি আমার এবং আমাদের পরিবারের জন্য অনন্য এক গর্বের বিষয়। আমি শেষ বয়সে উপনিত। তারপরও আমি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দল ও সমিতের খেলা দেখতে ঢাকা যাবো। আগে যখনই সমিত ছুটি কাটাতে বাড়িতে আসতো নিরবে-নিভৃতে বাড়িতে থেকে চলে যেত। আর এখন তার প্রতিক্ষায় পুরো এলাকা। সবাই অত্যন্ত আনন্দের সাথে তার অপেক্ষায়। অনেকেই বাড়িতে আসছেন তার খোঁজখবর নিতে। জানতে চাইছেন সমিত কবে আসবে। ঢাকাসহ মৌলভীবাজার জেলার সংবাদকর্মীরাও প্রতিনিয়তই ভিড় করছেন বাড়িতে। মানুষের এই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে আমাদের পরিবারের সদস্যরা গর্বিত। ছোট বেলা থেকে অসংখ্যবার দেশে এসে নিজ বাড়িতে থেকেছে সমিত। সর্বশেষ সে দেশে এসেছিলো ২০২২ সালে। সে সময়ে সমিত ১৫ দিন গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে ফুটবলের ব্যস্ত সূচি থাকায় কানাডা ফিরে যায়।’
সমিতের পিসি (ফুফু) পদ্মা সোম বলেন, ‘আমাদের সমিত অত্যন্ত সাদাসিদা জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাকে দেখলে বা তার সাথে কথা বললে মনেই হবে না সে এতো বড় একজন খেলোয়ার। সে কানাডা জাতীয় দল ও ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। তার খেলা কানাডায় অনেক দেখেছি। এবার তার খেলা ঢাকায় গিয়ে দেখবো। দেশের জার্সি পরিধান করে জাতীয় দলের হয়ে আমাদের সমিত মাঠে নামবে এটি ভাবতেই শিহরণ অনুভব করছি। সে কানাডায় থেকেও দেশের প্রতি তার টান আর মমত্ববোধ আমাদের পরিবারকে গর্বিত করেছে। আমার বাবা শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সিনিয়র শিক্ষক প্রয়াত মানিক লাল সোমও ছিলেন একজন বিখ্যাত খেলোয়ার। তিনি সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ফুটবলের মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি রেফারী হিসেবে মাঠে ছিলেন। এই পরিবারের সদস্য সমিত এখন মাঠ মাতাচ্ছে। কানাডায় তাকে (সমিত) যদি কেউ জিজ্ঞেস করে সে ফুটবল খেলা শিখলো কোথায়? জবাবে সে একবাক্যে বলে ছোটবেলা দাদার কাছে শিখেছি। আমরা সমিতকে নিয়ে গর্বিত।’
সমিত সোমের কাকাতো (চাচাতো) ভাই সৌরভ সোম বলেন, ‘আমাদের সোম বাড়ি আগে থেকেই এলাকায় প্রসিদ্ধ ছিল। এখন আমার ভাইয়ার জন্য পুরো দেশে পরিচিত হয়ে ওঠছে। ভাইয়া আসবেন আগামী ৩ জুন। তাকে বরণে আমাদের এলাকায় এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এলাকার তরুণ-যুবকরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাড়ির সামনে ভাইয়ার একটি বড় মনোমেন্ট তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের।’
সমিতের কাকি (চাচী) শুক্লা সোম বলেন, ‘তার পছন্দের খাবার হলো দেশি মুরগি, ডাল, ভাত আর পিঠা। সে যখনই দেশে আসে তখন আমরা তার সব পছন্দের খাবার তৈরি করি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। আমরা তার অপেক্ষায় রয়েছি। বাংলাদেশের হয়ে তার অভিষেক ম্যাচে আমরা পুরো পরিবার তার ও দেশের খেলা দেখতে ঢাকায় যাবো।’
উত্তরসুর গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন ফুটবলার ও সমাজকর্মী পরিমল দাশ বলেন, ‘সমিত আমাদের গর্বের ধন। আমরা টিভিতে, ইউটিউবে তার খেলা দেখেছি। মাঝ মাঠের সৈনিক সমিতের ড্রিবলিং, পাসিং অসাধারণ। আমি আগে থেকেই তার খেলার মুগ্ধ দর্শক। তার দেশপ্রেমের জুড়ি মেলা ভার। সে দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলবে শুনে খুবই আনন্দিত অনুভব করছি। ঢাকা যাবো বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে তার অভিষেক ম্যাচ দেখতে। আমাদের পাশের উপজেলা বাহুবলের (হবিগঞ্জ জেলা) সন্তান প্রবাসী ফুটবলার হামজা চৌধুরীর জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে ভারতের বিপক্ষে। এরপরই আমাদের সন্তার সমিত সোমের অভিষেক হতে যাচ্ছে। শুনছি আরো কিছু বাংলাদেশি বংশদ্ভূত প্রবাসী ফুটবলার দেশের জার্সিতে মাঠ মাতাতে আগ্রহী। সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ একদিন বিশ্ব ফুটবলের নতুন শক্তিতে রূপান্তর হবে সে স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।’