lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
রবিবার, ১ জুন, ২০২৫
Last Updated 2025-06-01T06:25:20Z
জাতীয়

বয়সভিত্তিক জাতীয় ফুটবল দলের মধ্যমনি শ্রীমঙ্গলের স্যামুয়েল রাকসাম

Advertisement


 


ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:

স্যামুয়েল রাকসাম সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এক আলোচিত নাম। অতি সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৯ ফুটবল টুর্নামেন্টে মাঝমাঠের এই খেলোয়ার অনবদ্য ক্রীড়া নৈপন্য দেখিয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলামোদিদেরও। অনুর্ধ-১৯ বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল সাফ ফুটবলের ফাইনালে ভারতের মাটিতে স্বাগতিকদের সাথে পুরো ৯০ মিনিট চোখে চোখ রেখে খেললেও ট্রাইব্রেকার নামক লটারিতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরাজিত হয়ে রানারআপ হয়। সে দলের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা ছিলেন ৮ নম্বর জার্সিধারী স্যামুয়েল রাকসাম। পুরো টুর্নামেন্টে বল কন্ট্রোল, পজিশন ধরে রেখে খেলার গতি নিয়ন্ত্রণ, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, ছোট-ছোট পাশে খেলা তৈরি ও প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গে দ্রুতগতিতে হানা দেবার মাধ্যমে স্যামুয়েল রাকসাম বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ দলের পক্ষে ফাইনাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সাথে জানান দিয়েছে আগামী দিনে সে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে হামজা চৌধুরী, সমিত সোমদের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করতে যাচ্ছে। পুরো টুর্নামেন্টে স্যামুয়েল রাকসাম একজন আদর্শ মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করে সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। ভারত সফর ও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লীগের খেলা শেষে গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) স্যামুয়েল রাকসাম পা রাখেন তার জন্মস্থান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাজদিহি চা বাগানের ফাঁড়ি ফুলছড়ার গারো লাইনের বাড়িতে। ওইদিন বিকেলে ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমি ও তার গ্রামবাসী তাকে এবং তার বাবা, মাকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছে। প্রথমে ভৈরবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তাকে মাল্যভূষিত করে কেক কেটে তাকে স্বাগত জানানো হয়। পরে তার বাড়িতে তাকে ও তার বাবা-মাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমি, স্থানীয় গ্রামবাসীরা। এ সময় স্থানীয় ফুটবলারবৃন্দসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের মাজদিহি চা বাগানের ফাঁড়ি ফুলছড়ার গারো লাইনের বাসিন্দা ওই বাগানের নিরাপত্তা প্রহরী টন সাংমা ও গৃহিনী নেফলা রাকসামের ৫ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ট সন্তান স্যামুয়েল রাকসাম। শৈশব থেকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বেড়ে উঠলেও ফুটবলের প্রতি গভীর টান ও দৃঢ় সংকল্পকে পুঁজি করে সে ধীরে ধীরে ওঠছে অনন্য উচ্চতায়। চা বাগানে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করে স্যামুয়েলের বাবা দৈনিক হাজিরা পান ১৭০ টাকা। এ টাকায় দিন এনে দিন খেয়ে কোনরকম চলছে তার পরিবার। বাগানের জমিতে এক দুই কক্ষের মাটির দেয়ালের ঘরই তাদের পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। ঘরে স্যামুয়েল রাকসামের বিভিন্ন সময়ে অর্জিত ট্রপি, মেডেল ও ক্রেস্টগুলো রাখার একটি আলমিরাও নেই। 

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের সন্তান স্যামুয়েল রাকসামের ফুটবল খেলা শুরু পাড়ার গারো লাইন ফুটবল মাঠে। ২০১৯ সালে সে স্থানীয় ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হয়। সেখানে কোচ সালেহ আহমদের তত্ত্বাবধানে কঠোর পরিশ্রমে স্যামুয়েল বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে মৌলভীবাজার জেলা দল, সিলেট বিভাগীয় দল পেরিয়ে নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে। এছাড়া বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লীগে চলতি মৌসুমে স্যামুয়েল রাকসাম খেলেছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে। তার ক্লাব ওই লীগে রানারআপ হয়েছে।

স্যামুয়েল রাকসামের ফুফাতো ভাই রোমান টিগিডি বলে, ‘স্যামুয়েল আমার মামাতো ভাই। সে গত কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়ার মাঠে অনুর্ধ-১৯ টুর্নামেন্টে খেলেছে। সে অনেক ভালো খেলেছে। আমি তার খেলায় অনেক খুশি।’

স্যামুয়েলের বন্ধু লোকমান মিয়া বলেন, ‘স্যামুয়েল রাকসাম আমাদের ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমির ছাত্র। আমরা একসাথেই ফুটবল খেলি একাডেমিতে। আমরা স্যামুয়েলসহ একাডেমির কয়েকজন সিলেটে একসাথে ট্রায়ালে ছিলাম। স্যামুয়েল সুযোগ পেয়েছে, আমরা পাইনি। সে বাংলাদেশের হয়ে অনুর্ধ-১৭, অনুর্ধ-১৯ সাফ ফুটবলে খেলেছে। ইনশাল্লাহ সে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে ভালো কিছু উপহার দেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’

স্থানীয় ফুটবলার জয় বর্ধন বলেন, ‘স্যামুয়েলের জন্য শুভ কমনা। এ বছর সে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লীগে খেলেছে। আগামী সিজনে যেন সে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের খেলতে পারে সে প্রার্থনা রইলো। এবার সে অনুর্ধ-১৯ সাফ ফুটবলে খেলেছে। তার খেলা অসাধারণ। সামনে যেন সে আরো ভালো করতে পারে সে জন্য সকলের কাছে দোয়া ও আর্শীবাদ চাই।’

স্যামুয়েল রাকসাম বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালে ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমিকে সালেহ আহমদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শুরু করি। স্যারের মাধ্যমে আমি অনুর্ধ-১৫ ফুটবলে অংশ নেবার জন্য মৌলভীবাজার জেলায় ট্রায়াল দিয়ে সুযোগ পাই। এরপর সিলেট বিভাগে ট্রায়াল দিয়ে ঢাকাতে ট্রায়াল দেই। সেখানে আমি অনুর্ধ-১৫ জাতীয় দলে সুযোগ পাই। পরে আমি অনুর্ধ-১৭ জাতীয় দলে সুযোগ পাই এবং সাফ চ্যাম্পিয়ানশীপ খেলতে শ্রীলঙ্কা যাই। টুর্নামেন্টে আমরা শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভারতের সাথে খেলি। ২০২৫ সালে আমি জাতীয় অনুর্ধ-১৯ দলে সুযোগ লাভ করি এবং ভারতে গিয়ে সাফ অনুর্ধ-১৯ টুর্নামেন্টে খেলি এবং রানারআপ হই। আমি ঢাকা লীগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের এলিট হয়ে এ বছর আমি আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের হয়ে খেলেছি। সেখানে আমরা রানারআপ হয়েছি। আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলা এবং দেশকে আমি কিছু দিতে চাই।’

ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও নন্দিত ফুটবল কোচ সালেহ আহমদ বলেন, ‘২০১২ সালে আমি আমার এ একাডেমিটা শুরু করি। আমাদের এই একাডেমি থেকে আমরা গর্ববোধ করছি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের নিভৃত একটি গ্রামের সন্তান স্যামুয়েল রাকসাম সাফ অনুর্ধ-১৯ ফুটবল টুর্নামেন্টে অনবদ্য কেলা প্রদর্শন করেছে। সদ্য সমাপ্ত অনুর্ধ-১৯ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে ভারতের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ট্রাইব্রেকারে হেরে বাংলাদেশ দল রানারআপ হয়। আমরা আশাবাদী আমাদের এই ভৈরবগঞ্জ ফুটবল একাডেমি থেকে আরো বয়সভিত্তিক ফুটবলাররা স্যামুয়েলকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বের দরবারে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণ করবে।’

স্যামুয়েল রাকসামের বাবা ফুলছড়া চা বাগানের নিরাপত্তা প্রহরী টন সাংমা বলেন, ‘আমি দিনমজুরী কাজ করি। আমার ছোট ছেলে স্যামুয়েল সালেহ ভাইয়ের একাডেমিতে খেলে তার শিক্ষা-দীক্ষায় জাতীয় টিমে যেতে পারছে। বাবা হিসেবে আমি অত্যন্ত গর্বিত।’