Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
গ্রাম্য সালিশের রায় না মানায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রাম মোহাজেরাবাদ দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা দিনমজুর মো. হাসিম মিয়ার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রীয় আইনে সমাজচ্যুত করার কোন আইন বা বিধান নেই। তারপরও ওই পরিবারকে সমাজচ্যুত করে পরিবারটির মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। সমাজচ্যুত ঘোষণা করা পরিবারটির সদস্যদের সাথে গ্রামের সাধারণ মানুষদের চলাফেরা, সম্পর্ক রাখা, লেনদেন ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে প্রভাবশালী সালিশকারীদের পক্ষ থেকে। প্রায় মাসাধিককাল ধরে ওই পরিবারটিকে সামাজিক, ধর্মীয়সহ সব ধরণের কার্য থেকে বিচ্ছিন্ন এমনকি পরিবারটির কর্তা মো. হাসিম মিয়া স্থানীয় মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি হলেও মসজিদে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামাজ পর্যন্ত পড়তে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
দিনমজুর মো. হাসিম মিয়া অভিযোগ করেন, ২০২০ সালে তার ছেলে ঠেলাচালক আমিনুল ইসলাম বাবু ও একই এলাকার রমজান মিয়ার মেয়ে মোছা. মরিয়ম আক্তারের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সময় দুই পরিবারের সম্মতিতে উভয় পক্ষের অভিভাবক ও স্থানীয় মুরব্বি মন্নান মিয়া, নূর মিয়া, আনু মিয়াসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সামাজিকভাবে আমিনুল ইসলাম বাবুর সাথে মরিয়ম আক্তারের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের সময় বাবুর বয়স মাত্র ১৭ ও মরিয়মের বয়স মাত্র ১৬ হওয়ায় তাদের বিয়ের রেজিস্টার বা কাবিননামা করা হয়নি। তবে মৌখিকভাবে বিয়ের দেনমোহর ৭০ হাজার টাকা ধার্য্য করে বিয়ে সম্পন্ন করেন এলাকাবাসী। বিয়ের দুই বছর পর তাদের সংসারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ঠেলাচালক আমিনুল ইসলাম বাবু স্থানীয় লেবু ও আনারস বাগানে দিন-মজুরীর কাজ করে এবং প্রায় দিনই ভোর রাত সাড়ে তিনটার দিকে লেবু ও আনারস ঠেলাগাড়িতে করে শ্রীমঙ্গলের আড়তে নিয়ে যায়। চলতি বছরের ৫ জুন ভোর রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে আমিনুল ইসলাম বাবু আড়তের উদ্দেশ্যে চলে যাবার পর তার স্ত্রী মরিয়ম আক্তার একই এলাকার মতলিব মিয়ার ছেলে নাজমুলের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। ঘটনাটি বুঝতে পেরে হাসিম মিয়া তার ছেলের বউ ও নাজমুলকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন। এরপরও তিন বছরের মেয়ের কথা চিন্তা করে বাবু তার স্ত্রী মরিয়মকে ক্ষমা করে দেয় এবং তাকে নিয়ে সংসার করতে থাকে। এরই মধ্যে মরিয়ম কুরবানী ঈদের পর তার বাবার বাসায় বেড়াতে গেলে তার বাবা রমজান মিয়া রাতে নিজের মেয়েকে পরকীয়ায় সম্পৃক্ত নাজমুলের বাড়িতে দিয়ে আসেন। ঘটনাটি পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে গত ২৯ জুন মনতাজ উদ্দিন ভূইয়া, আনু মিয়া, আলী আমজাদ, রাজীব, শিশু মিয়াসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। সালিশে পরকীয়ার বিষয়টি মরিয়ম স্বীকার করলেও নাজমূল সবার সামনে তা অস্বীকার করে এবং উশৃঙ্খলতা শুরু করে। তখন আমিনুল ইসলাম বাবু রাগান্বিত হয়ে মরিয়মকে জনসম্মুখে তালাকের কথা বলে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে পুনরায় ৪ জুলাই পুনরায় সালিশের আয়োজন করা হয়। উক্ত শালিসের সভাপতি ছিলেন মোহাজেরাবাদ গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও পঞ্চায়েত সর্দার মো. আহাদ মিয়া (আব্দুল আহাদ)। সালিশের শুরুতেই তিনি হাসিম মিয়াকে হুমকি-ধামকি প্রদান করে সকলের সামনে বলপ্রদানপূর্বক ক্ষমা চাওয়ান। বিচারে তিনি (আহাদ) তার একক নেতৃত্বে একচেটিয়াভাবে হাসিম মিয়াকে দোষী সাব্যস্থ করে হাসিম মিয়াকে মরিয়ম ও নাজমূলের নামে মিথ্যা পরকীয়ার ঘটনা রটিয়েছেন বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মোহরানা ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা প্রদানের নির্দেশ দেন। তিনি টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে এক সপ্তাহ পর পুনরায় সালিশ ডেকে হাসিম মিয়া ও তার পরিবারকে জনসম্মুখে একঘরে বা সমাজচ্যুত বলে ঘোষণা করেন সালিশের সভাপতি আহাদ মিয়া। এরপর থেকে হাসিম মিয়া ও তার ছেলে আমিনুল ইসলাম বাবু বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়সহ সব ধরণের কার্য থেকে বিচ্ছিন্ন এমনকি মসজিদে নামাজ ও পড়তে পারছেন না। এ ব্যাপারে হাসিম মিয়া গত ৫ আগস্ট শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এ ব্যাপারে আমিনুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘আমার স্ত্রী মরিয়ম আমারই খালাতো ছোট ভাই নাজমুলের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। আমার বাবা তাদের হাতে-নাতে ধরার পর আমার খালাতো ভাই ও আমার স্ত্রী স্বীকার করেছে আমি ঠেলা নিয়ে যাবার পর নাজমুল আমার বাড়িতে আসতো। আমার স্ত্রীর স্বীকারোক্তি, অন্যান্য ডকুমেন্ট রেকর্ড আকারে আমার কাছে রয়েছে। তারপরও আমি আমাদের তিন বছর বয়সী অবুঝ মেয়ে সন্তানের কথা চিন্তা করে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। এরপরও বিষয়টি এলাকায় প্রচার হওয়ায় ও আমার খালার পরিবার এ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করায় আমি সালিশে মৌখিকভাবে আমার স্ত্রীকে তালাক দেই। যারা পরকীয় করে আমার সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করলো, আমার স্ত্রীকে সংসার ছাড়া করলো, আমার সন্তানকে মাতৃহারা করলো তাদের কোন বিচার না করে আমার ও আমার পরিবারের উপর বিচারকরা ২ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা চাপিয়ে দিয়েছেন। কা পরিশোধ করতে আমরা অক্ষম হওয়ায় বিচারকরা আমাদের পরিবারকে একঘরে (সমাজচ্যুত) করে দিয়েছে। অথচ আমাদের বিয়ের কাবিন মৌখিকভাবে স্বাব্যস্থ ছিল ৭০ হাজার টাকা। যা এলাকার মুরব্বিরা অবগত রয়েছে। বর্তমানে আমি কোন কাজে যেতে পারছি না। মাত্র তিন বছর বয়সী মেয়ে তোফা আক্তারকে নিয়ে সারাদিন কাটাতে হচ্ছে। আমি এর বিচার চাই।’
সালিশে উপস্থিত মুরব্বি মো. নুর মিয়া বলেন, ‘যেদিন সালিশে হাসিম মিয়াকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা সমাজচ্যুত বা একঘরে করা হয় সেদিন আমি সভাপতি আহাদ সাহেবের রায়ের প্রতি আপত্তি জানাই ও বাধা প্রদান করি। আরো কয়েকজন মুরব্বিও আপত্তি করেন এ নিয়ে। আমি আইনমতো ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছিলাম। কিন্তু সভাপতি কারো কথা শুনেননি। তখন আমি সভাপতিকে বলেছি দেখেন আপনি যেটা ভালো মনে করেন তা করেন। রাষ্ট্রীয় আইনে কাউকে সমাজচ্যুত করার কোন বিধান নেই তা আমরা জানি। কিন্তু সালিশে আমাদের গ্রামের সভাপতি কর্তৃক এ রায়ের ক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই ছিল না।’
অপর এক মুরব্বি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আহাদ মিয়া আমাদের এলাকার মুরব্বি। তিনি এলাকার আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি। উনার সভাপতিত্বে অনেক সালিশ হয়েছে এলাকায়। তিনি মেয়ের মোহরানা, অন্যান্য খরচ ও ইদ্দতকালীন সময়সহ নানাদিক বিবেচনা করে ছেলের বাবাকে ২ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য এক সপ্তাহ সময় দেন। এটি পরিশোধ না হওয়ায় এক সপ্তাহ পরে পুনরায় সালিশের মাধ্যমে হাসিম মিয়াকে একঘরে (সমাজচ্যুত) করার রায় দিয়েছেন। আমরা সালিশে উপস্থিত ছিলাম।’
সালিশ বিচারের সভাপতি শ্রীমঙ্গল সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের মোহরার মো. আব্দুল আহাদ (আহাদ মিয়া) বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বাবুর বাবা হাসিম মিয়া অভিযোগ করায় ভালোই হয়েছে। তিনি তার অভিযোগে যা উল্লেখ করেছেন তা শতভাগ মিথ্যে। আমার বিরুদ্ধে কোনটাই সে প্রমাণ করতে পারবে না। বরং সে ইউএনও সাহেবের কাছে আরো অপদস্থ হবে। আমি বিচারে যে রায় দিয়েছি তা আমার একার বক্তব্য নয়। তার ব্যাপারে সারা গ্রাম এক হয়েছে। অপরাাধ করলে আমরা তাকে ফাঁসি দিতে পারবো না, জেলে দিতে পারবো না, মারতেও পারবো না। তাই একঘরে করে দিয়েছি। কেউ অপরাধ করলে তাকে কি ছেড়ে দিতে হবে? সমাজচ্যুত করাটা সমাজের ব্যাপার। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা আইনগতভাবে সমাজচ্যুত করার বিধান না থাকলেও সমাজিকভাবে সমাজচ্যুত করার বিধান আছে। তাকে সাবুদ (ঠিক) করতে হলে এছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প কিছু ছিল না। সে (হাসিম মিয়া) পুরো গ্রামতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালে এ রায় না দিয়ে আমাদের কি করার আছে? এখানে পক্ষপাতিত্বের কিছু নেই। মোহাজেরাবাদ গ্রামে অসংখ্য বিচার করেছি আমি। কেউ বলতে পারবে না আমি পক্ষপাতমূলক বিচার করেছি।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘এটি একটি খারাপ উদাহরণ। যদি সত্যিই কাউকে সমাজচ্যুত করা হয়ে থাকে তবে এটি অন্যায় ও বেআইনী কাজ। কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। আমি বিষয়টি দেখছি।’