Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
আজ থেকে দুই দশক আগেও গ্রামবাংলায় পায়ে হেটে-হেটে মানুষের চুল, দাড়ি, গোফ ছাঁটার কাজ করতেন নরসুন্দররা (নাপিতরা)। খদ্দেরকে খোলা আকাশের নিচে টুলে বা চেয়ারে বসিয়ে নরসুন্দররা ছেটে দিতেন চুল, দাড়ি, গোফ। সে সময়ে সেলুনের খুব একটা প্রচলন ছিল না। কিন্তু এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত রয়েছে নামিদামি সেলুন। রয়েছে পুরুষদের পারলারও। এ কারনে আগেকার দিনের মতো এখন আর খোলা আকাশের নিচে টুলে বা চেয়ারে বসে চুল, দাঁড়ি, গোফ কাটানোর দৃশ্য চোখে পড়ে না। তবে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুদের, বিয়ে বাড়িতে বরের, পার্বনে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য চুল কাটতে এখনো নরসুন্দরদের ডাক পড়ে বাসা-বাড়িতে। কিন্তু মৌলভীবাজারের চা শিল্পাঞ্চলে এখনো দেখা মেলে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়নের কাকিয়াছড়া চা বাগানে পাকা সড়কের এক পাশে খোলা আকাশের নিচে দেখা যায় ৭৩ বছর বয়সী গোপি শীল নামের এক নরসুন্দরকে। সেখানে তিনি পাকা রাস্তার পাশে সপ্তাহের শুক্র, রবি ও বুধবারে চা শ্রমিকদের চুল, দাড়ি কাটা বা ছাঁটার কাজ করেন। এ তিন দিন খুব সকালে চুল কাটার বা ছাঁটার যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন শ্রীমঙ্গল শহরতলীর বিরাহিমপুর এলাকাস্থ ট্রলি রোডের বাসা থেকে। বাগানে পৌছে টেবিলের উপর কাঁচি, ক্ষুর, চুল কাটার মেশিন, ছোট আয়নাসহ অন্যান্য সামগ্রী সাজিয়ে রেখে অপেক্ষা করেন খদ্দেরের। ওই তিন দিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগানের খোলা আকাশের নিচে নরসুন্দরের কাজ করেন তিনি। আর এ পেশার মাধ্যমেই দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক গোপি শীল ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রাণান্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বড় মেয়ে মিনা শীল ওরফে কুন্তি শীল লেখাপড়া শেষ করে বাড়িতে রয়েছেন। বড় ছেলে রতন শীল ওরফে দীপক শীল লেখাপড়া শেষ করে খোলা বাজারে ফলের ব্যবসা করছেন। ছোট মেয়ে বিনা শীল মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী এবং ছোট ছেলে রবিন শীল শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
গোপি শীলের কাছে নিয়মিত চুল, দাড়ি কাটেন পাশের বাগানের শ্রমিক জগলু রাজবংশী। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে গোপী শীল কাকা আমাদের বাগানে চুল, দাড়ি কাটার কাজ করেন। বাইরে বসে কাজ করেন তিনি। বয়স অনেক হইলেও তিনি খুব পরিশ্রম করেন। সপ্তাহে তিনি দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগানে কাজ করেন তিনি। মাঝে-মধ্যে অবাক হই। একজন বয়স্ক মানুষ কিভাবে এতো কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন? তিনি বাগানে আসায় আমরা লাভবান। শহরে সেলুনে গিয়ে চুল, দাড়ি কাটাতে যে খরচ হয় কাকার কাছে তার অর্ধেকের চেয়েও কম লাগে।’
গোপি শীল বলেন, ‘এই ভ্রাম্যমাণ সেলুনে বাগানের শ্রমিকরা চুল, দাড়ি কাটেন। খুব ছোট বেলাতেই আমি মানুষের চুল, দাড়ি কাটার কাজ শুরু করি। বাপ-দাদার হাত ধরে সেই কিশোর বয়স থেকেই গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে ঘুরে ঘুরে মানুষের চুল, দাড়ি কেটেছি। কত মানুষের সঙ্গে চেনা-জানা। পরে দীর্ঘদিন আমি শ্রীমঙ্গল শহরের নতুন বাজারে সিঁড়ির নিচে পিঁড়িতে বসিয়ে মানুষের চুল, দাড়ি, গোপ কাটার কাজ করেছি। কয়েক বছর আগে আমিসহ কয়েকজন নাপিতকে আকস্মিক বাজার থেকে উচ্ছেদ করার পর হতোদ্যম হয়ে পড়ি। কয়েকদিন বেকার থাকার পর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আবারও কেঁচি, ক্ষুর হাতে তুলে নেই। সে সময় থেকেই কাকিয়াছড়া চা বাগানে কালভার্ট সংলগ্ন পাকা রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে শ্রমিকদের চুল, দাড়ি কাটার কাজ করছি। প্রতিজনে চুল কাটতে ৫০ টাকা, দাড়ি কাটতে ৪০-৫০ টাকা করে নেই। সারাদিন কাজ করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়। এই টাকা ও বর্তমানে বড় ছেলের উপার্জিত টাকা দিয়ে চলে আমাদের সংসার এবং কলেজে অধ্যায়ণরত দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ। দুই জনের উপার্জনেও মাস শেষে সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। এখনো বড় মেয়ের বিয়ে দিতে পারিনি। তারপরও ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করতে পেরেছি এটাই জীবনের সার্থকতা।’