Advertisement
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার প্রায় ১৫টি স্পটে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অমান্য করে অবাধে দুই ফসলি জমির মাটি কাটছে কয়েকটি মাটি খেকো চক্র। এক্সক্যাভেটর (ভেকু) দিয়ে গর্ত করে এসব মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন পরিবেশ দপ্তরের লাইসেন্স বিহীন ইট ভাটাগুলোতে। এতে উর্বরতা হারাচ্ছে ফসলী জমিগুলো। কুড়িগ্রাম ও নাগেশ্বরী উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও মিলছে না এর কোন প্রতিকার। নাগেশ্বরী সরকারি কমিশনার (ভূমি)'র দাবি, ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি পরিবেশ দপ্তরের লাইসেন্স বিহীন ইট ভাটাগুলোকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রাম। সীমান্ত ঘেষাঁ, ১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত ও সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চল। ৯টি উপজেলা ও ৩টি পৌরসভার প্রান্তিক চাষিরা বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করে জমিতে দুইবার ফসল চাষ করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটান। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, নাগেশ্বরী উপজেলার মাটি উর্বর, এঁটেল দোআঁশ প্রকৃতির। এ মাটিতে পানি নিষ্কাশন কম হয় বলে অল্প সেচেই ভালো ফসল ফলে। ধান, পাট, আখ, ভুট্টা ও শাকসবজি এই অঞ্চলের প্রধান ফসল। এসব জমির ওপরের অংশের মাটি এঁটেল হওয়ায় নিচু এলাকা ভরাটে অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাটি খেকো ব্যবসায়ী চক্রের সদস্যরা কৃষকদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ৩হাজার টাকায় ১হাজার মাটি কিনে নিয়ে বিভিন্ন এলাকার ইট ভাটাগুলোতে ১হাজার মাটি ৮হাজার থেকে ১০হাজার টাকা বিক্রি করছে। এতে তারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি।
নাগেশ্বরীর নেওয়াশী ইউনিয়নের এগারোমাথা ও গাগলা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মনু মিয়া, আব্দুল জব্বার, আব্দুল মান্নান, শহিদুল ইসলাম জানান, নেওয়াশী ইউনিয়নের এগারোমাথা সওজের রাস্তা সংলগ্ন (গাগলা-এগারোমাথা নুরানি ও হাফেজী মাদ্রাসা) সংলগ্ন দুই ফসলী জমিসহ এগারোমাথা ব্যাংঙ দোলার পাড় গ্রামের ইয়াসির মেম্বারের দুই ফসলী জমিতে এরশাদ আলী চক্র দাপটের সাথে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করছেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ নেতা নাগেশ্বরী জনতা ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী মতিয়ার রহমানের মেসার্স জেবিএল, এএন এবং এলটিবি ইট ভাটায়। ফলে নষ্ট হচ্ছে দুই ফসলি জমি ও পাকা রাস্তাঘাট। শিক্ষার্থী ও পথচারীদের চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ছে রাস্তাগুলো। গতবছর অনেকের জমি থেকে উর্বর মাটি কেটে নেওয়ার কারণে সে সব জমিতে চাষবাস হচ্ছে না। মাটি ব্যবসায়ীরা জমির মালিকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভেকু দিয়ে মাটি তুলছেন।
নাগেশ্বরী পৌরসভার প্রান্তিক কৃষক মনজুর হক, আব্দুস সালাম, মাইদুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম, আবু বক্কর জানান, দুই ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে অবৈধ ইট ভাটাগুলোতে বিক্রির মহোৎসব চলছে। নাগেশ্বরী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড আশারমোড় থেকে নাখারগঞ্জ রাস্তা সংলগ্ন কাউয়া হোসেনের বাড়ীর পাশে বাচ্চু আলীর দুই ফসলী জমিতে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে আলম ও নুরনবী চক্র বিক্রি করছেন বাঁশেরতল হারিসুল বারী রনির ইটভাটায়। পাশাপাশি বল্লভপুর (কানছুর মোড়) বাহার মাস্টারের দুই ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে আয়নাল হক ও আদম আলী বিক্রি করছেন ভাসানী বাজার খাইরুল মিয়ার ইটভাটায়। পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বল্লভপুর (ভাসানী বাজার) থেকে পূর্বে ধান ব্যবসায়ী ইউনুস আলীর বাড়ির পিছনে ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে আয়নাল হক বিক্রি করছেন ভাসানী বাজার খাইরুল মিয়ার ইটভাটায়। পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের মধুরহাইল্লা (ধনিটারী) আজিজ কমিশনারের ভাই হাকিমের জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে দুলু মিয়া বিক্রি করছেন দক্ষিন ব্যাপারীরহাট আকরাম হোসেন ইটভাটায়।
বামনডাঙ্গা ও রায়গঞ্জ ইউনিয়নের আমজাদ হোসেন, বাবু মিয়া, নজরুল ইসলাম, শামীম হোসেন জানান, বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের তেলিয়ানিরপাড় গ্রামে দুই ফসলী জমি থেকে ৩টি ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করছেন আলম। রায়গঞ্জ ইউনিয়নের রায়গঞ্জ বালিকা স্কুল সংলগ জাকির হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে পুকুর নির্মাণ করার নামে ব্যাপারীহাট মুরাদ ব্যাপারীর ইট ভাটায় মাটি বিক্রি করছেন।
নাজির হোসেন, ফজলুল হক, আসির উদ্দিনসহ অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের পর বছর ফসল চাষ করায় জমির ওপরের অংশের মাটির উৎপাদন ক্ষমতা কমে আসছে। মাটি খেকো কয়েকটি চক্র মফস্বল অঞ্চলের কৃষককে ফুঁসলিয়ে মাটি বিক্রিতে আগ্রহী করে তুলছে। অনেক জমি থেকে ৩ ফুট থেকে ৭ ফুট গভীর করে মাটি তোলা হচ্ছে আর ওই জমি ডোবায় পরিণত হচ্ছে। অনেকে আবার ফসলি জমিতে মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি করছেন। এতে দিন দিন কমে আসছে ফসলি জমি। অন্যদিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন অনেক মাটি ব্যবসায়ী ও কয়েকজন পরিবেশ দপ্তরের লাইসেন্স বিহীন ইট ভাটার মালিক। এসব গ্রামের পাকা ও কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে মাটি ট্রাক্টর পরিবহন করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তাঘাট। ধুলাবালু ছড়িয়ে পড়ছে এলাকায়। মাটি খেকো ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী। তাই কেউ প্রতিবাদের সাহস পান না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
মাটি খেকো সিন্ডিকেট চক্রের আলম মিয়া, এরশাদ আলী, আলম ও নুরনবী, আয়নাল হক ও দুলু জানান, যে সব জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে, সে সব জমির কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। জমির উপরিভাগের এক ফুট মাটি কাটা হচ্ছে। জমির মালিকরা স্বেচ্ছায় মাটি বিক্রি করছেন। তাতে ওই জমিতে ভালো ফসল হবে। টাকা হলেই প্রশাসন ও সাংবাদিকদপর ম্যানেজ করা কোন ব্যাপার না।
নাগেশ্বরী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বদরুজ্জামান রিশাদ বলেন, আমাদের নজরে পড়লে বা কেউ জানালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধে অভিযান চলছে। পাশাপাশি পরিবেশ দপ্তরের লাইসেন্স বিহীন ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক অন্নপূর্ণা দেবনাথ বলেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অমান্য করে ফসলি জমির মাটি কাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


