Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর প্রেষণে থাকার অভিযোগ ওঠেছে উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবণীর বিরুদ্ধে। নিজ কর্মস্থলকে সমস্যা সংকুল অবস্থায় ফেলে তিনি দুই বছরের যাবত প্রেষণে রয়েছেন শহরের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই প্রতিষ্ঠানে (চন্দ্রনাথ) বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার (প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী) মা লাভলী দত্ত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানার কারনে ইতোপূর্বে প্রিয়াংকা দত্ত লাবনীকে কারন দর্শানো নোটিশ প্রদান ও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। বিভাগীয় মামলায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তিনি ‘তিরস্কার দন্ডে’ দÐিত হন। এরপরও জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বারংবার চেষ্টা করেও তাকে মূল বিদ্যালয়ের ফেরাতে পারছেন না। ফলে তার মূল বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার কারনে শ্রেণি কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষ দিকে শহরের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক) লাভলী দত্ত, প্রনবেশ কুমার চৌধুরী ও শিবানী দে বিভিন্ন কারনে ছুটিতে যান। ওই সময়কালে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার লিখিত সুপারিশ ও প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শামসুর রহমান ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই এক লিখিত অফিস আদেশে শর্তসাপেক্ষে ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবণীকে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাময়িক সংযুক্তি প্রদান করেন। সংযুক্তি আদেশে শর্ত ছিল সংযুক্তি প্রদানকৃত বিদ্যালয়ে ছুটিতে থাকা শিক্ষকরা যোগদানের সাথে সাথে এ আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ও পরবর্তী বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে ছুটিতে থাকা চন্দ্রনাথ স্কুলে শিক্ষকরা যোগদানের করলেও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চন্দ্রনাথ বিদ্যালয়েই পাঠদান চালিয়ে যান শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ২৮ মে তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম তাকে সংযুক্তি মেয়াদ শেষ হবার পরও মূল বিদ্যালয়ে যোগদান না করায় কারন দর্শাণো নোটিশ প্রেরণ করেন। ওই বছরের ১ জুলাই দ্বিতীয় দফা নোটিশ প্রদানের পর প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী সে নোটিশের জবাব প্রদান করেন। এ নিয়ে তদন্ত সম্পন্ন হবার পর ওই বছরের ৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় এবং তাকে তিরস্কার দন্ড প্রদান করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সর্বশেষ গত ৩০ জুন মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সফিউল আলম ওই শিক্ষকের সংযুক্তি আদেশ বাতিলের প্রস্তাবসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে প্রেরণ করেছেন।
সরেজমিন ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১১৯ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে প্রধান শিক্ষকসহ কর্মরত রয়েছেন ৫ জন। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানা কাজে উপজেলা শিক্ষ অফিসসহ বির্ভিন্ন অফিসে যেতে হয়। কোন শিক্ষক ছুটিতে গেলে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় অথবা দুই শ্রেণিতে একত্র করে শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে হয়। প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী প্রেষণে থাকায় বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের পদটি শুন্য ঘোষণা করা যাচ্ছে না। পলে কোন নতুন শিক্ষকও ওই বিদ্যালয়ে পদায়ন সম্ভব হচ্ছে না। মূল কর্মস্থলে ফেরার জন্য ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক-অভিভাবক কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের পক্ষ থেকে শিক্ষক প্রিয়াংকা লাবনীর বিষয়ে বার বার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবক কমিটির সভাপতি মো. রিপন মিয়া এবং ম্যানেজিং কমিটির (এডহক) সদস্য মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘সংযুক্তি প্রদানকৃত স্কুলে ছুটিতে থাকা শিক্ষক দুই মাস পর যোগদান করলেও শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী মূল কর্মস্থলে যোগদান না করায় ২০২৪ সালের ২০ মার্চ ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. মতিউর রশিদ, পিটিএ’র সভাপতি মো. উস্তার মিয়া এবং এসএমসির সহসভাপতি মো. ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে জমা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই প্রিয়াংকা দত্ত লাবনীকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার। এ চিঠিতে দফাওয়ারী জবাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে অত্রাফিসে দাখিল করার জন্য বলা হয়। পরবর্তীতে অপর একটি অভিযোগ জেলা প্রশাসক বরাবর আরও দাখিল করা হয়। অভিযোগ উল্লেখ করা হয়, বিগত ফ্যাসিবাদি সরকারের ডামি কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবনীকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ১৩.০৭.২০২৩ তারিখে প্রদত্ত আদেশে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্তি প্রদান করা হয়। অফিস আদেশ অনুযায়ী সংযুক্তি প্রদানকৃত বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যোগদানের সাথে সাথে এ আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হওয়ার কথা থাকলেও লাবনী ওই আদেশ মানেননি। এরই প্রেক্ষিতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার এর সাথে দেখা করে সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরকারি বিধি মোতাবেক ২০.০৩.২০২৪ তারিখে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন জমা দেওয়া হয়। সমন্বিত অনলাইন বদলি নির্দেশিকা-২০২৩ তারিখ : ১০.১০.২০২৩ এর ৫.১ অনুযায়ী বিটিপিটি প্রশিক্ষণ, মাতৃত্বজনিত ছুটিসহ কিছু নিদিষ্ট কারণে একজন শিক্ষককে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সংযুক্তির আদেশ প্রদান এবং মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্তির আদেশ বাতিল হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া একই শিক্ষককে একাধিক বার সংযুক্তির আদেশ দেওয়া যাবে না বলেও নির্দেশিকায় উল্লেখ রয়েছে। একই নির্দেশিকার ৪.৬ অনুযায়ী সমন্বয়ের প্রয়োজন হলে জানামতে সিনিয়রকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে আসর বিধান রয়েছে।
চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে দুই শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম চলমান। মোট শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা ১০টি। সংযুক্ত শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী সহ বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ১৭ জন। ১০টি শ্রেণিতে ১০ জন শিক্ষক ক্লাস করালেও আরও ৭ জন শিক্ষক অফিস কক্ষে বসে থাকতে হয়। ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লাভলী দত্ত, প্রনবেশ কুমার চৌধুরী ও মহামায়া শর্মার ছুটি জনিত কারনে প্রিয়াংকা দত্ত লাবনীকে ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল। আমেরিকা ভ্রমণ শেষে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে লাবলী দত্ত, ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসা ছুটি শেষে প্রনবেশ কুমার চৌধুরী এবং পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষে মহামায়া শর্মা বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কিন্তু ওই তিন জন শিক্ষকের বিপরীতে যে শিক্ষককে সংযুক্তি প্রদান করা হয়েছিল সে শিক্ষক অফিস আদেশ লংঘন করে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ত্যাগ করে নিজ বিদ্যালয় যোগদান করেননি।
এ ব্যাপারে ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমীর কুমার ঘোষ বলেন, ‘ডেপুটেশনে যাওয়া শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে মূল কর্মস্থল থেকে বেতন নিচ্ছেন। অফিস আদেশ লঙ্ঘন করে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এখনো ডেপুটেশনে রয়েছেন। ফলে ফটকী বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। উনি সাময়িক সময়ের জন্য ডেপুটেশনে গিয়ে আর ফিরেননি। আমি ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা বিদ্যালয়ের কল্যাণার্থে তাকে ফেরানোর প্রচেষ্টা চালানোতে এখন তিনি আমাকে তার স্বামীর মাধ্যমে হেরেজম্যান্ট ও নানাভাবে হেনস্তা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। উনি মূল বিদ্যালয়ের ফিরে না আসায় পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কোনো শিক্ষককে স্কুল থেকে ডেপুটেশনে নেয়া হয় ওই স্কুলে তার পদটি শূন্য দেখায় না। ফলে তার পদে কাউকে নেওয়া যায় না।’
শিক্ষক প্রিয়াংকা দত্ত লাবনী বলেন, ‘সংযুক্তি আদেশের পর আমি চন্দ্রনাথে দায়িত্ব পালন করছি। আমি বারবার এখান থেকে আমার মূল কর্মস্থলে যাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার স্যারের নির্দেশে এ বিদ্যালয়ে রয়েছি। পরবর্তীতে নানাভাবে আমাকে ফটকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্যসহ অন্যান্যরা হুমকি-ধামকি প্রদান করেন। প্রাণনাশের আশঙ্কায় মূল কর্মস্থলে যোগদান করছি না। আমাকে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নানাভাবে অপমান-হেনস্তা করছেন। এরইমধ্যে গত বছরের ২৯ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এক পত্রে আমাকে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় দফা সংযুক্তির আদেশ দিয়েছেন। এখানে কতদিন সংযুক্তি থাকবো তার মেয়াদকাল উল্লেখ নেই ওই পত্রে।’
চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লাভলী দত্ত বলেন, ‘ডেপুটেশনে আসা প্রিয়াংকা দত্ত নিজ ইচ্ছায় চন্দ্র্রনাথে রয়েছেন এমনটি নয়। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের আদেশে এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই তিনি থেকেছেন। তার ডেপুটেশনের কাগজে কোনো তারিখ উল্লেখ ছিল না। তারপরও তিনি নিজ কর্মস্থলে যাবার প্রস্তুতি নিলেও তাকে নানাভাবে হেনস্তা ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে জীবন হুমকির মুখে থাকায় প্রিয়াংকা মূল কর্মস্থলে যাচ্ছে না। আর আমিও আমার মেয়েকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রিয়াংকা দত্ত লাবনীকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের এক আদেশে ২০২৩ সালের ১৩ জুন সাময়িক সময়ের জন্য শর্তসাপেক্ষে ডেপুটেশনে চন্দ্রনাথ সরকারি বিদ্যালয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি আবার মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় ডেপুটেশনের আদেশ নিয়ে আসেন। আদেশে কোনো তারিখ না থাকায় জটিলতায় রয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সফিউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা আছে। ডেপুটেশন বাতিল চেয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। অফিস আদেশ না মানার কারণে এর আগে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে তাকে শোকজ করা হয়, পরবর্তীতে বিভাগীয় মামলায় তিরস্কার দন্ডও দেওয়া হয়।’